করোনাগণমাধ্যমফিচারলিড স্টোরিশুক্রবারের বিশেষ
করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়েছে প্রায় ১০০ নারী সাংবাদিক
প্রয়োজন গণমাধ্যম কর্মী আইন
বাংলাদেশে করোনায় এ পর্যন্ত চাকুরিচ্যুত হয়েছে ১০০ জন নারী সাংবাদিক । এর বাইরেও আরো প্রায় ১০০ জনের সংখ্যা রয়েছে, যারা লজ্জা ও ভয়ে চাকুরীচ্যুত হওয়ার বিষয়ে মুখ খুলেনি । এবং অনেককে বাধ্যতামূলক রিজাইন করানো হয়েছে । প্রতিকুল এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ চাকুরিচ্যুত হওয়া এই নারী সাংবাদিকরা অনেককেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে । তারই তথ্য তুলে ধরেছেন ফারহানা নীলা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, এক নারী সাংবাদিক, কাজ করতেন একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে । ৮ বছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন । বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তখন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরেছে। সে সময় হঠাৎ একদিন অফিসে গেলে, প্রশাসন থেকে বলা হয়, আপনার চাকরী নেই। কেনো প্রশ্ন করলে প্রশাসন থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লোকসানে আছে, এটিই কারণ। অশ্রুশিক্ত চোখে ওই নারী সাংবাদিক বলেন, “ আমার প্রতিষ্ঠান লোকসানে ছিল না। বিভিন্ন বিভাগ থেকে ১৮ জনকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ জন সাংবাদিককে চাকুরীচ্যুত করা হয়। আর সেই ৪ জন-ই আমরা নারী সাংবাদিক। আমার চাকরী ফিরে পেতে অনুরোধ করেছি। আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার বাবা মা বৃদ্ধ। সংসারের হাল আমার অর্থেই চলতো। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে আমি যে দুঃসময় পার করেছি। তা যেনো আর কারো জীবনে না আসে। এমন কি চাকরী চলে যাওয়ায় অন্য প্রতিষ্ঠানে আমাকে নিয়োগ দিতে চায় না।”
মারিয়া সালাম নামে এক নারী সাংবাদিক সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা থেকে রিজাইন দিতে বাধ্য হয়েছেন। করোনকালে সাংবাদিকদের ঢালাওভাবে চাকরিচ্যুতির ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নারী সাংবাদিকদের অধিকার লঙ্ঘন, হয়রানি, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে । করোনার ঝুঁকি নিয়ে নারীরা পুরুষের সমানতালে কাজ করছেন। অথচ গণমাধ্যমগুলোর ‘সংবাদকর্মী ছাঁটাই নীতির’ প্রয়োগ শুরুই হচ্ছে নারী কর্মীদের চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে পরিবারের পুরুষদের উপরে নির্ভরশীল, এই ধারণা থেকে মূলত অনেক প্রতিষ্ঠানে শুরুতেই নারী সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। যোগ্যতার ভিত্তিতে নয় বরং পুরানো ধ্যান ধারণা থেকেই নারীদের এভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।’’
২০১৯ নভেম্বর থেকে এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত চাকুরিচ্যুত হয়েছে প্রায় ১০০ নারী সাংবাদিক: সাউথ এশিয়া আর্টিকেল নাইনটিন ও গণমাধ্যম কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ এর দেয়া তথ্যে ২০১৯ এর নভেম্বর থেকে ২০২০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত নারী সাংবাদিকদের ছাটাইয়ের তালিকাটি নিম্নরূপ :
মিডিয়া | চাকুরীচ্যুত নারী সাংবাদিক |
গাজী টিভি | ২ জন |
দিপ্ত টিভি | ৩ জন |
এস এ টিভি | ৪ জন |
এন টিভি | ৩ জন |
বাংলা ভিশন | ১ জন |
একাত্তর টিভি | ২ জন |
মোহনা টিভি | ৪ জন |
রেডিও ধ্বনি | ১ জন |
কেপিটাল এফ এম | ১ জন |
আলোকিত বাংলাদেশ | ২ জন |
সারা বাংলা | ১ জন |
দৈনিক কালের কন্ঠ | ৩ জন |
দৈনিক দিনকাল | ২ জন |
দৈনিক সমকাল | ২ জন |
দৈনিক জনকণ্ঠ | ১ জন |
লাল সবুজের কথা | ১ জন |
দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিন | ১ জন |
দৈনিক পূর্বপশ্চিম | ২ জন |
শেয়ার বিজ | ১ জন |
ফ্লাশ টিভি ২৪ | ১ জন |
জলেশ্বরী. কম | ১ জন |
বাংলার চোখ. নেট | ১ জন |
সারাদেশে প্রায় ১০০ জন নারী সাংবাদিক চাকুরিচ্যুত হয়েছেন :আহম্মেদ ফয়েজ
গণমাধ্যম কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ এর আহ্বায়ক আহম্মেদ ফয়েজ জানান ‘আমাদের গণমাধ্যম আমাদের অধিকার-এর হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত চার হাজারের মতো গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারানোসহ নানা ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কমপক্ষে ১২০০ সরাসরি চাকরিচ্যুতি ও ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন ৷ এর মধ্যে সারাদেশে প্রায় ১০০ জন নারী সাংবাদিক চাকুরিচ্যুত হয়েছেন। এর বাইরেও আরো প্রায় ১০০ জনের সংখ্যা রয়েছে যারা লজ্জা ও ভয়ে মুখ খোলেন নি। অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের উৎসব ভাতা দেয়নি। এই সময়ে নারী কর্মীরাও অন্য সময়ের তুলনায় বেশী প্রতিকূলতার শিকার হয়েছেন।’’
শুধু মহামারির সময়ই নয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিকরা সব সময়ই নানাভাবে বঞ্চিত : নাসিমুন আরা হক মিনু
শুধু মহামারির সময়ই নয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিকরা সব সময়ই নানাভাবে বঞ্চিত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একটু একটু করে বাড়ছে নারী উপস্থিতি। কিন্তু তাও পুরুষের তুলনায় তার পরিসংখ্যান খুবই নগন্য। সর্বমোট কতজন নারী সাংবাদিকতায় আছেন তার কোনো পরিসংখ্যান বর্তমানে নেই। তবে পত্রিকা, অনলাইন ও টেলিভিশন মিলিয়ে সংবাদমাধ্যমে কর্মরত নারীর সংখ্যা আনুমানিক এক হাজার ৷
আরেকটি হিসেব দিয়ে বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকদের পরিস্থিতি বোঝা যায়
সাংবাদিক সংগঠন | মোট সদস্য সংখ্যা | পুরুষ সাংবাদিক | নারী সাংবাদিক |
জাতীয় প্রেসক্লাব | ১২১২ | ১১৩১ | ৮১ |
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন | ৩১৬১ | ২৮৬১ | ৩০০ |
ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি | ১৮৪৫ | ১৭০০ | ১৪৫ |
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র | ৫০০ | ৫০০ | |
মোট | ৬৭১৮ | ৫৬৯২ | ১০২৬ |
নাসিমুন আরা মিনু বলেন, এই সংক্ষিপ্ত সংখ্যা থেকেও নানা অযুহাতে চাকুরিচ্যুত করা হচ্ছে নারী সাংবাদিকদের । তার একটি বড় আঘাত এসে পৌঁছেছে করনা পরিস্থিতির এই সময়ে । বেশ কিছু কারনে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মিডিয়া হাউজ গুলো নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। আবার প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই পুরুষ। ফলে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের দেখা যায় খুব কম। সাংবাদিকতায় নারীর সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তাঁরা যেতে পারছেন না। সম্পাদক পদে হাতে গোনা ৩/৪ জন আছেন।
নাসিমুন আর হক মিনু বলেন, আমাদের সমাজে মনে করা হয় চাকরি একটি পুরুষের যত দরকার, নারীর ততটা দরকার নয়। একজন কর্মজীবী নারীকে বাইরে কাজের পাশাপাশি ঘরের কাজকর্ম সামলাতে হয়। বাড়তি কাজের চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। সংসার-সন্তান সামলাতে গিয়ে অনেকে মাঝপথে পেশা ছেড়ে দেন।
সাউথ এশিয়া আর্টিকেল ১৯ এর আঞ্চলিক পরিচালক, ফারুখ ফয়সল বলেছেন, স্বাভাবিক সময়েই দেশের নারী সাংবাদিকরা বেতন ভাতা পদ পদবী নিয়ে বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। করোনা মহামারীতে তা বেড়ে ১০০% হয়ে গেছে। এ সময়ে
৯৬ % নারী গণমাধ্যমকর্মী অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। সাংবাদিকতায় নারীরা শোষিত ও অবহেলিত। চাকুরিচ্যুতদের তালিকায় প্রথম আঘাতটাই আসে নারীদের ওপর। আর্টিকেল নাইনটিন এ বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। আর করোনার সময়ে সেই সুযোগটিকে আরো কাজে লাগিয়েছে মিডিয়া মালিকরা। কয়েক দশকের পুরানো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নারী কর্মীদের বেতন কমিয়েছে, যথাযথ নোটিশ ছাড়াই চলে যেতে বলেছে, আবার কিছু প্রতিষ্ঠান অনেক নারী সাংবাদিককে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠিয়েছে।
ফারুখ ফয়সল বলেন, এই পরিস্থিতিতে, আর্টিকেল -১৯ অস্থায়ীভাবে বেকার নারী সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তার জন্য পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছে । এ প্রকল্পের আওতায় মহামারি চলাকালীন বিভিন্ন কর্মস্থল থেকে ছিটকে পড়া নারী সাংবাদিকদের ঢাকা অফিসে আর্টিকেল নাইনটিন দলের সাথে সাময়িকভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে এভাবে অন্যায়ভাবে চাকুরীচ্যুত ঘটনা যাতে না হয়। সেদিকে সরকারের আরো দৃষ্টি দেয়া উচিত।
প্রয়োজন গণমাধ্যম কর্মী আইন: শাকিল আহমেদ
ব্রডকাস্ট সাংবাদিকদের সংগঠন বিজেসি-এর সদস্য সচিব এবং একাত্তর টিভির হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মিডিয়ার একটি বাজে সংস্কৃতি হলো, নারী যখন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায় তখন তাদেরকে সরকারি নির্ধারিত ৬ মাসের ছুটি দিতে হবে এ চিন্তা করে নারীদের ওপর আঘাতটা বেশি পড়ে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান লোকসানে আছে বলে চাকুরিচ্যুত করছেন, তাদের তথ্যটি সঠিক নয়। কারন লকডাউনে সবাই বাসায় বসে সংবাদ দেখছে। জনগণ টিভি দেখেই সময় কাটাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মিডিয়া মোটেও খারাপ পরিস্থিতিতে নেই। গত এক বছরে দেখেছি একটি চ্যানেলের পুরো বার্তা বিভাগই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ ওই একটি চ্যানেল থেকেই কমপক্ষে ১২০ জন কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে৷ আরো নয়টি চ্যানেল থেকে জনবল ছাঁটাই করা হয়েছে৷ ফলে ছাঁটায়ের সংখ্যাটি কম নয়৷ আর এর একটি বড় অংশই হচ্ছে নারী৷
তিনি বলেন, নিয়মবহির্ভূত এমন ছাঁটাই প্রক্রিয়া বন্ধে প্রথমেই প্রয়োজন গণমাধ্যম কর্মী আইন।
হাজারো বাঁধার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নারী সাংবাদিকরা: আঙ্গুর নাহার মন্টি
এতো বাঁধার মধ্যেও আমাদের নারী সাংবাদিকরা এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বেসরকারী টেলিভিশনের নিউজ ২৪ এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি। আমাদের নারী সাংবাদিকরা অনেক পুরুষ সাংবাদিকের চেয়েও এগিয়ে আছে। যদি নারীদের ভালো পরিবেশ দেয়া হয়, দেখা যাবে তারা আরো বেশি এগিয়ে যাবে। এখনো হাতে গোনা যত নারীই আছে, অনেকেই তাদের যোগ্যতা বলে ভালো বিটে রিপোর্ট করছে। ক্রাইমে আমাদের অনেক নারী সাংবাদিকরা কাজ করছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকতার মতো পেশায় আরো নারীদের উপস্থিতি বাড়ানোর কথা বলেছেন। এছাড়াও করোনা পরিস্থিতিতে কোনো সাংবাদিকদের যেনো চাকুরিচ্যুত না করা হয় তার নির্দেশ দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী। কিন্তু তারপরও সঠিক গণমাধ্যম আইন না থাকায়, নানা অযুহাত দেখিয়ে এখনো ছাঁটাই পর্ব চালিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া হাউজগুলো। আর তাই নারী সাংবাদিকদের চাওয়া একটি গনমাধ্যম কর্মী আইন।
ফারহানা নীলা
সিনিয়র রিপোর্টার, নিউজ নাউ বাংলা