মাদক ও অবৈধ ভারতীয় পণ্যের নিরাপদ রুট ‘আশুগঞ্জ টোল প্লাজা’

আমিরজাদা চৌধুরী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া : মাদক ও অবৈধ ভারতীয় পণ্য চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোল প্লাজা। পুলিশি ‘মাসোহারা’ বাণিজ্যের মাধ্যমে মাদকসহ অবৈধ ভারতীয় পণ্য রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে।
আশুগঞ্জ থানার এসআই মো. ইসহাক মিয়া, টোল প্লাজা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এবং থানার ওসি মোহা. বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে চোরাকারবারিদের লাখ লাখ টাকার ‘মাসোহারা’ বাণিজ্য চলছে বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, গেল ১৫ জানুয়ারি এসআই ইসহাক আশুগঞ্জ থানায় যোগদান করেন। এর তিনদিন পরই তিনি টোল প্লাজা পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্ব পান। তিনি যখন সীমান্তবর্তী বিজয়নগর থানায় কর্মরত ছিলেন, তখন মাদক কারবারি ও চোরাকারবারিদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারিরা ভারত থেকে অবৈধ পথে আসা মাদক ও পণ্য সামগ্রী নিরাপদে পাচার করে আসছে।
রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় পাচার করতে এসআই ইসহাকের সঙ্গে ‘মাসোহারা’ চুক্তিতে পণ্য পাচার হচ্ছে নিয়মিত। পণ্যগুলো হচ্ছে, গাঁজা, ফেনসিডিল, এসকফ সিরাপ, মদ, ইয়াবা থেকে শুরু করে কিটক্যাট চকলেট, কসমেটিকস, সুপারি, কাতান শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস, জিরা, চিনি, ওষুধ, মোবাইল এবং মোবাইলের অ্যাকসেসরিজসহ বিভিন্ন সামগ্রী।
আশুগঞ্জ টোল প্লাজা হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শেষ চেকপোস্ট। তাই এর গুরুত্বও অনেক। এটি পার হতে পারলে আর কোনো ঝুঁকি থাকে না চোরাকারবারিদের। এই পথে ভারতীয় অবৈধ পণ্য পাচার নির্বিঘ্ন করতে গাড়ি প্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘মাসোহারা’ আদায় করা হয়, যার একটি বড় অংশ যায় থানার ওসির পকেটে।
জানা গেছে, মাত্র দেড় মাসের মতো পুলিশ ফাঁড়িতে ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন এসআই ইসহাক। এই কর্মকর্তা যোগদানের আগে যেখানে প্রতি মাসে মাদক ও চোরাচালানবিরোধী অন্তত ২০-৩০টি মামলা হতো, সেখানে গত চার মাসে তা রেকর্ড সংখ্যক কমে গেছে।
থানার রেকর্ড বলছে, জানুয়ারি মাসে টোল প্লাজা এলাকায় ১৫টি মামলা হলেও এরপর সাড়ে তিন মাসে (৩০ এপ্রিল পর্যন্ত) থানা ও টোল প্লাজা মিলিয়ে মাত্র ৩৭টি মামলা হয়েছে।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বিজয়নগরের বিষ্ণুপুর গ্রামের চিহ্নিত চোরাকারবারি হানিফ মেম্বার, জালাল, সিঙ্গারবিল গ্রামের জহির, সেতু, জসিম, চান্দুরা ইউনিয়নের আলাদাউদপুরের রহিম, শাহআলম, জালালপুরের ফজলুর রহমান প্রকাশ বজলু, আকতার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মাসুক, এবং ভৈরবের স্বপন দাদা, ঢাকার সাইফুল চাচাসহ এমন বহু চিহ্নিত মাদক ও চোরাকারবারি এখন পুলিশের সঙ্গে সমঝোতায় অবৈধ পণ্য পাচার করছেন।
কিটক্যাট চকলেট, ওষুধ, কসমেটিকস, সুপারি, কাতান শাড়ি, থ্রিপিস, চিনি, জিরাসহ ভারতীয় অবৈধ পণ্য প্রতিটি ট্রিপে ৩০-৪০ হাজার টাকার মাসোহারা দিয়ে নিরাপদে পাচার হচ্ছে। এসব চোরাকারবারিদের গাড়ি স্বয়ং পুলিশ সদস্যরাই আশুগঞ্জ সদরের হাইওয়ে হোটেল উজানভাটি ও রাজমনির সামনে থেকে এস্কট দিয়ে পার করে দেো হয়।
এদিকে, ‘মাসোহারা’ বণ্টন নিয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে কনস্টেবল রাকিবকে বাঞ্ছারামপুরে এবং এসবের প্রতিবাদ করায় হেদায়েত নামের আরেক কনস্টেবলকে নাসিরনগরের প্রত্যন্ত চাতলপাড়ে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় বলেও জানা গেছে।
বিজয়নগর থানায় কর্মরত থাকাকালেও এসআই ইসহাকের বিরুদ্ধে মাদককান্ডে জড়ানোর অভিযোগ ছিল। গেল বছরের জুন মাসে বিজয়নগরের জালালপুর গ্রামের আরজু মিয়ার বাড়ি থেকে ৭০ বোতল ফেনসিডিল ও ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধারের পর মামলার জব্দ তালিকায় ১৫ বোতল ও ২০ কেজি উল্লেখ করা হয়। বাকি মাদক স্থানীয় এক কারবারির কাছে বিক্রি করারও অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও আরজু মিয়ার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে এসআই ইসহাকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি গুরুতর অসুস্থ। উপরওয়ালা স্বাক্ষী, আমার জানামতে এরকম কারো সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নাই। কেউ হয়তো ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কথা বলছে।
আশুগঞ্জ থানার ওসি মোহা. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। টোল প্লাজা থেকে মাদক বা অবৈধ পণ্য পাওয়া গেলে মামলা দেয়া হয়। ‘মাসোহারা’ আদায়ের বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, অভিযোগের বিষয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে খোঁজ নেয়া হবে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউজ নাউ বাংলা / ০২ মে ২০২৫/ জেডআরসি